একটা স্বপ্ন সে প্রায়ই দেখে। ইসতিয়াকের পাখা গজিয়েছে। পরীদের মত। সেই পাখা দিয়ে সে উড়ে বেড়াচ্ছে তার বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে – খোলা রাস্তা, গাছপালা সবকিছুর উপর দিয়ে। এক ঝাক কবুতর আর কয়েকটা শালিক সাই সাই করে ছুটে চলে যায় তার পাশ দিয়ে। এভাবে অনেকক্ষণ পরীর মত পাখাগুলো মেলে উড়ে বেড়ায় সে, নিজের ইচ্ছেমত। একসময় সে উড়ে যেতে চায় আরো উপরে, আকাশের দিকে, যতদূর চোখ যায় – ওর মন চায় সূর্যটাকে ছুঁতে। উড়তে উড়তে সে চলে আসে একদম মেঘের রাজ্যে। মেঘের পর মেঘ কাটিয়ে সে উড়ে যায় দুরন্ত গতিতে। একসময় সে থামে। তার কি যেন একটা মনে হয় – দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় তার। সে ফিরে যেতে চায় তার বাড়িতে, মাকে দেখতে। এমন সময় মেঘের মধ্য থেকে একটা হাত এসে তার হাতটা ধরে ফেলে। হাতটা অদ্ভুত নরম একটা হাত, কিন্তু ধরাটা খুব শক্ত, যেন সে পড়ে যেতে নিচ্ছে আর তাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সেই হাতটা, বাঁচানোর জন্য। সে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখতে চায়, কে তার হাতটা এমনভাবে ধরলো। চেহারাটা দেখতে যাবে ঠিক সেসময়ে তার ঘুমটা ভেঙে যায়। প্রতিদিনই এমনটা হয়।
+++++++++++++++
ইসতিয়াক ভার্সিটিতে এসেছে। ওর প্রতিদিনের অভ্যাস। অন্যমনষ্ক হয়ে সে তাকিয়ে আছে সুবর্ণার দিকে। সুবর্ণা অবশ্য খেয়াল করে না কখনো ব্যাপারটা। শুধু আনমনে মাঝে মাঝে কানের উপর এসে যাওয়া চুলগুলো সরিয়ে নেয় সে। তারপর আবার কথায় মনযোগ দেয়। হাতের নড়াচড়ায় চুড়ির আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পায় ইসতিয়াক। কি বলবে বুঝে পায় না ইসতিয়াক। মনে মনে সে শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে – কি নিপুন হাত তার!
সুবর্ণা তার কেউ হয় না। শুধুই ক্লাসমেট। ক্লাসমেটও না। তাদের সেকশন ভিন্ন। সৃষ্টিকর্তার খেলার নিয়মেই তাদের দেখা হয়ে যায় একদিন। ভাগ্যের সেই খেলাই আবার তাদেরকে নিয়ে এসে আজ বসিয়ে দিয়েছে ক্যান্টিনে! অবশ্য তারা একা নয়। তাদের সাথে বাগড়া দিতে এসেছে তারই আরেক ক্লাসমেট, সুবর্ণার ক্লাসেরই একটা ছেলে। অবশ্য সে এতে বিরক্ত হয় না। সে জানে যে অন্যকেউ থাকলে সুবর্ণা লক্ষ্য করবে না – আর সে সুযোগে আনমনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারবে সে সুবর্ণার দিকে। তাই সে মেনে নিয়েছে ব্যাপারটা। ইসতিয়াক এক দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে আছে ওর দিকে। মনে মনে শুধু ভাবছে, “তুই তো কিনেই নিয়েছিস আমায়!”
হঠাৎ টুংটাং শব্দে ইসতিয়াকের ধ্যান ভেঙে গেল। ক্যান্টিনের বয়টা চা নিয়ে এসেছে। ইসতিয়াক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিতে নিতে গুনে দেখলো, দু'কাপ চা এসেছে। প্রথমে দুকাপেরই অর্ডার দেয়া হয়েছিল, ওরা দুজনই শুধু ছিল তখন। ঐ ছেলেটা আসার পর আর নতুন করে অর্ডার দেয়া হয় নি। বাগড়া দিক আর যা-ই দিক – চা কম থাকাটা সইবে না ঐ ছেলেটার। তাই সে তাড়াতাড়ি করে বলল, "মামা, আরেক কাপ লাগবে যে!”
বলতে বলতে নিজের কাপটা সুবর্ণার ক্লাসমেটের সামনে দিয়ে দিল। সুবর্ণা শুধু চায়ের কাপের দিকে এক পলক তাকালো, তারপর আবারও তার কথায় ব্যস্ত হয়ে গেল। বয়টা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল, চা আনতে। ইসতিয়াক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, সুবর্ণার ডিস্টার্ব হয় নি তো?! নাহ, সুবর্ণার মধ্যবয়স্ক যুবতী চোখগুলো দিয়ে সে তাকিয়ে আছে ওর ক্লাসমেটের দিকে, খুব ভাল মনযোগ ওর। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ইসতিয়াকের চোখগুলো সুবর্ণার মধ্যে আরেকবার ডুবে যেতে নিলো, ঠিক মুহূর্তেই সুবর্ণা তার দিকে তাকালো। "ইসতিয়াক ভাই, আজ উঠি। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।"
একটু হতচকিত হয়ে সে বলল, “আরে, চা-টা তো শেষ করো… ভাই আপনি তো নিলেনই না।"
ছেলেটা তাড়াহুড়োয় শুধু বলল, “আজ না, আরেকদিন হবে।”
সুবর্ণা বলল, “আচ্ছা ইসতিয়াক ভাই, আসি।”
ইসতিয়াক চাইছিল সুবর্ণা আরেকটু থাকুক, আরেকটু কথা বলুক, আরেকটু তার নয়ন জুড়ানো চোখগুলোতে হারিয়ে যেতে পারুক সে। কিন্তু ভাগ্য সেই সুযোগ দিল না।
আসলে ইসতিয়াক সুবর্ণার জীবনে কিছুই না। সুবর্ণা যে সুন্দর গান গাইতে পারে সেটা শুনলে যে কেউ ওর জন্য পাগল হয়ে যাবে। সুবর্ণা সবকিছুতেই খুব ভাল। লেখাপড়ায়ও বেশ। তার একটা সুন্দর গুণ হচ্ছে সে সবার সাথে কথা বলে, বিপদে-আপদে সবার পাশে থাকার চেষ্টা করে। এভাবেই তো তার সাথে পরিচয় ইসতিয়াকের। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের দিন সে কলম আনতে ভুলে গিয়েছিল। অনেক অন্যমনস্ক তো সে! তার ঠিত পাশেই সিট পড়েছিল সুবর্ণার – ভাগ্য যে কিভাবে মিলিয়ে দিল তাদের! তখন সুবর্ণা একটা কলম ধার দিয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হল কলমটা হাতে নেয়ার সময় ইসতিয়াকের মধ্যে কেমন যেন একটা উপলব্ধি কাজ করল। মনে হচ্ছিল যেন সারাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সত্য যেন সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল এই উপলব্ধিটা আর কখনো জীবনে কোন মেয়ের কাছ থেকে সে পায় নি। মনে মনে বলে সে, “বিশ্বাস কর, আমি তোর দেহের প্রেমে পড়ি নি রে, অন্যদের মত। আমি তোর মনের প্রেমে পড়েছি। তুই খুব ভালো একটা মেয়ে।”
চায়ের দাম দিয়ে সে উঠে গেল ক্যান্টিন থেকে।
ইসতিয়াকেরও ক্লাস আছে। তবে আধাঘণ্টা পর। কি করবে আর, সে লাইব্রেরির দিকে রওনা হল। ভার্সিটিতে তার আর কোন ক্লোজ বন্ধুও নেই, যে আড্ডা দিবে। তাই সে লাইব্রেরিতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়।
লাইব্রেরিতে গিয়েই সে গ্রিক মিথোলজির মানে গ্রিক পুরাণের বইটা নিয়ে বসলো। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে সে। সুবর্ণাও পড়ে একই বিষয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রদের গ্রিক পুরাণের এসব কাহিনী জানা থাকা লাগে, নাহলে তো লোকে হাসবে! যদিও এগুলো কোনদিন সত্য ছিল না, শুধুই গল্প, তবে পড়তে কিন্তু খুব মজার। তখনকার গ্রিক লোকেরা দেব দেবীতে বিশ্বাস করতো। সেই দেব দেবীরা নাকি থাকতো "অলিমপাস” নামে এক পাহাড়ের উপরে। একেক দেবতার ছিল একেকরকম ক্ষমতা। কেউ ছিল যুদ্ধের দেবতা, কেউবা প্রকৃতির। তাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি, বাক-বিতণ্ডা আর প্রেম – এই সব নিয়েই যত কাহিনী। প্রসঙ্গ বোঝাতে বইয়ের পাতায় পাতায় অসংখ্য দেব দেবীর ছবি দেয়া আছে বইটায়। এক পাতায় লেখা, আরেক পাতায় ছবি। ছবিগুলো অবশ্য মোটেও শালীন নয়। সেসব ছবি দেখলে যেকোন মৌলভী টাইপ লোক দশবার তওবা করবে! কিন্তু লেখাপড়ার বিষয় তো, পড়তে তো হবেই।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে একসময় ইসতিয়াক এসে পড়ে ভালোবাসার দেবতা কিউপিডের পাতায়। কিউপিড নাকি মানুষের মধ্যে ভালোবাসা জাগাতে পারতো। দেবতা হলেও সে বাচ্চা শিশুর রূপ ধারণ করতো এবং তার পিঠে তীর নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। যার ভেতরে ভালোবাসা জাগ্রত করতে চাইতো তাকে তার জাদুময় একটা তীর মেরে বসতো। তীরের জাদুতে তখন সেই লোকটার ভিতরে ভালোবাসার আবেগ চলে আসতো!
সুবর্ণা বোধহয় তাকে ঠিক এমনই একটা তীর ছুড়ে মেরেছে! এজন্যই বোধহয় সে এতটা চাইতে শুরু করেছে সুবর্ণাকে। যদিও সুবর্ণা কিছুই জানে না এসবের। এত কাছে থেকেও সে জানে না কোনকিছু – ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে ইসতিয়াকের। কাছের এক বন্ধুকে যেমন আরেক বন্ধু কোন খবর জানাতে চায়, ঠিক তেমনি বলে ফেলতে ইচ্ছে করে, “এ্যাই জানিস! আমার না তোকে ভাল লাগে। কেন জানিস? তুই অন্যদের থেকে অন্যরকম তো, তাই।” ভেবে মনে মনে হাসে ইসতিয়াক। কিন্তু না, জানানো যাবে না। সে চায় তার বলাটা স্পেশাল হোক। এটা নিয়েই সে ভাবে শুধু আজকাল। সে অন্যদের মত শুধু কয়েকটা মুখস্থ শব্দ বলতে চায় না। তার ভালোবাসা তো আর অন্যদের মত নয়, অন্যদের মত প্রকাশ করলে চলবে না। মনে মনে বলে সে, "কিভাবে বলি তোকে? কিভাবে বলি ভালোবাসি?”
++++++++++++++++
আবারও সেই স্বপ্ন।
আজকাল বেড়ে গেছে স্বপ্নটা। এখন সে প্রতিদিন দেখে স্বপ্নটা। ঐ আগের স্বপ্নই। কিন্তু কোনদিন সেই চেহারাটা দেখতে পায় না সে।
একদিন এক পলক দেখেছিল চেহারাটা। কিন্তু ইসতিয়াকের মা সেদিন এমনভাবে তাকে ঘুম থেকে ডেকেছিল যে কবরস্থানের লাশও বোধহয় উঠে যাবে। উঠে দেখলো ডাকের তোড়ে সে সব ভুলে গেছে।
ওঠার পর দাত ব্রাশ করতে করতে সে মনে করার চেষ্টা করলো চেহারাটা। কিন্তু নাহ্! কিছুতেই মনে পড়লো না।
+++++++++++++++++
ক্যাম্পাসে তুমুল বৃষ্টি। সকালে রোদ ছিল, কিন্তু বেলা গড়াতে গড়াতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ক্যাম্পাসের খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলে মেয়েগুলো সব দৌড়ে দৌড়ে দালানের আশ্রয়ে চলে আসতে শুরু করলো – বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য।
ইসতিয়াক এতক্ষণ দেখছিল এসব কাণ্ড। তার মত আরো অনেকে ভীড় জমিয়েছে করিডোরে, বৃষ্টি দেখবে বলে। ভিড়ের জোড়ে রেলিংয়ের কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে মোটামুটি ঠেলে ঠুলে সে রেলিংয়ের কাছে চলে আসলো। সারাজীবনে অনেক বৃষ্টি দেখেছে সে। কিন্তু এই বৃষ্টিটার মায়া কেন যেন অন্যরকম লাগলো তার কাছে। বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে সে দেখছিল বৃষ্টির দৃশ্য। কেন যেন আজ বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে কাছে গিয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে তার। কি অপরূপ সুন্দর সে দৃশ্য! হাত বাইরে দিয়ে কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটাকে অনুভব করতে চাইলো। কিন্তু মনে হয় পারলো না।
এমন সময় তার খেয়াল হল, সুবর্ণা কোথায়? সে কি এসেছে আজ? মনে মনে ভাবে সে, “যখন তোকে খুব দরকার, তখনই পাই না কাছে।"
নাহ! যে করেই হোক-- আজ খুঁজতেই হবে সুবর্ণাকে। করিডোরে থাকা মেয়ে ছেলেগুলোকে প্রায় ঠেলেঠুলে সে খুঁজতে লাগলো সুবর্ণাকে। তার যেন কোন রুমে ক্লাস আজ? খুঁজতে খুঁজতে মনে হল পুরো ভার্সিটিটা অন্যদিনের চেয়ে আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। এত বড় ভার্সিটিতে কিভাবে খুঁজে করবে সে আজ সুবর্ণাকে?
প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ইসতিয়াক এসে পড়লো সুবর্ণার ক্লাসরুমের কাছে। ক্লাসরুমের দরজায় দেখা হয়ে গেল সুবর্ণার এক ক্লাসমেটের সাথে। ক্লাসমেটকে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, “সুবর্ণা কোথায়? জানো কিছু?”
“কি জানি ভাই, বলতে পারলাম না।”
ক্লাসরুমের ভেতরে ঢুকে দেখে প্রায় জনশূণ্য রুম। সবাই বাইরে বৃষ্টিমুখর পরিবেশ উপভোগ করছে। গুটিকয়েক লোকজন ক্লাসের ভিতর ছিল। তারা এদিক সেদিক অলস সময় কাটাচ্ছিল। কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছিল, আর কেউ মোবাইল ফোনে ব্যস্ত। কিন্তু কোথাও সুবর্ণাকে দেখা যাচ্ছে না। একজনকে কাছে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভায়া, সুবর্ণাকে দেখেছেন? আজ এসেছে ও?”
সে বলল, “হ্যাঁ, একটু আগে তো এখানেই ছিল। এখন...”
ইসতিয়াক শুধু বললো, “ধন্যবাদ...” বলেই ছুটে পালিয়ে গেল ক্লাসরুম থেকে। সে জানে কোথায় গেছে সে।
যে দালানটাতে এতক্ষণ ছিল সে, তার ঠিক পিছনেই একটা বড় ফুটবল মাঠ। সেখানটাতে অনেক সময় কাটিয়েছে ইসতিয়াক আর সুবর্ণা। তার মন বলছে ওখানেই তাকে পাবে সে। মোটামুটি আরেকটা দৌড় লাগালো সে।
হুম, ঠিক তাই। আসলেই একদম পারফেক্ট। এরকমটাই চাইছিল সে। পরিবেশটা একেবারে কল্পলোকের মত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বিশাল এক সবুজ মাঠ, ঘাসে ঢাকা। লোকজন বলতে গেলে নেই। একজোড়া স্যান্ডেল হাতে নিয়ে কে যেন একজন দাড়িয়ে আছে। পড়নে তার একটা নীল – নাহ, আকাশী রঙয়ের জামা, আর দুহাতে নীল রঙয়ের চুড়ি। বিশাল সেই সবুজ মাঠের বুকে ছোট্ট সেই মানুষটাকে একটা নীল-আকাশী পরীর মত লাগছিল।
ইসতিয়াক ধীরে ধীরে কাছে যায় তার, একদম ধীর পায়ে – যাতে সে টের না পায়। হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছিল সামান্য ঘাসও যেন অনেক উচু গর্জন করছে আজ -- তার নীরব উপস্থিতি যেন প্রকাশ করে দিতে চাইছে ঐ পরীটার কাছে। তারপরও ঘাসের উপর পা বুলিয়ে ধীরপায়ে সে এগিয়ে গেল, ঐ পরীটার দিকে। একসময় সে এসে পড়লো প্রায় তার পাশাপাশি। আড়চোখে সে তাকিয়ে দেখতে পেল পরীটা চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে – বাম হাতে স্যান্ডেল জোড়া ধরা আর ডান হাত দিয়ে বাম হাতটাকে ধরে রেখেছে। মাথাটা আলতোভাবে অন্যপাশে হেলে রেখেছে। তার ঘাড়ের চামড়ার উপর অলসভাবে কিছু ভেজা চুল এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। চুলগুলো সরে যাওয়ায় দেখতে পেল, তার কানে একটা নীল ঝালর যেন তারই অপেক্ষায় দোল খাইছে মাঝে মাঝে।
ইসতিয়াক মনে মনে বললো, “আমি পারবো না। আমি পারবো না রে। আমায় মাফ করে দিস।”
বৃষ্টির মাঝেও মেঘের দল ভর করলো তার মনে। বেদনার বৃষ্টিস্নাত হতাশা নিয়ে সে ফিরে যেতে চাইলো। সে পা বাড়ালো উল্টো দিকে। শুধু শুধুই জামা কাপড় ভিজিয়েছে সে… বন্ধুরা দেখলে তো হাসবে। ব্যাগে থাকা রুমালটা দিয়ে মাথাটা মুছে ফেলতে হবে, নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে--এগুলোই ভাবছিল সে। হঠাৎ করে একটা হাত এসে তার হাতটা ধরে ফেললো। হাতটা অদ্ভুত নরম একটা হাত, কিন্তু ধরাটা খুব শক্ত, যেন সে পড়ে যেতে নিচ্ছে সে অবস্থায় তাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সেই হাতটা, বাঁচানোর জন্য। তাহলে কি ইসতিয়াকের আনমনে তাকিয়ে থাকা সবই বুঝতে পেরেছিল সে?
আদনান শামীম, ১৯/০২/২০১৬
এডিট: ১২/০৭/২০১৬
+++++++++++++++
ইসতিয়াক ভার্সিটিতে এসেছে। ওর প্রতিদিনের অভ্যাস। অন্যমনষ্ক হয়ে সে তাকিয়ে আছে সুবর্ণার দিকে। সুবর্ণা অবশ্য খেয়াল করে না কখনো ব্যাপারটা। শুধু আনমনে মাঝে মাঝে কানের উপর এসে যাওয়া চুলগুলো সরিয়ে নেয় সে। তারপর আবার কথায় মনযোগ দেয়। হাতের নড়াচড়ায় চুড়ির আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পায় ইসতিয়াক। কি বলবে বুঝে পায় না ইসতিয়াক। মনে মনে সে শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে – কি নিপুন হাত তার!
সুবর্ণা তার কেউ হয় না। শুধুই ক্লাসমেট। ক্লাসমেটও না। তাদের সেকশন ভিন্ন। সৃষ্টিকর্তার খেলার নিয়মেই তাদের দেখা হয়ে যায় একদিন। ভাগ্যের সেই খেলাই আবার তাদেরকে নিয়ে এসে আজ বসিয়ে দিয়েছে ক্যান্টিনে! অবশ্য তারা একা নয়। তাদের সাথে বাগড়া দিতে এসেছে তারই আরেক ক্লাসমেট, সুবর্ণার ক্লাসেরই একটা ছেলে। অবশ্য সে এতে বিরক্ত হয় না। সে জানে যে অন্যকেউ থাকলে সুবর্ণা লক্ষ্য করবে না – আর সে সুযোগে আনমনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারবে সে সুবর্ণার দিকে। তাই সে মেনে নিয়েছে ব্যাপারটা। ইসতিয়াক এক দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে আছে ওর দিকে। মনে মনে শুধু ভাবছে, “তুই তো কিনেই নিয়েছিস আমায়!”
হঠাৎ টুংটাং শব্দে ইসতিয়াকের ধ্যান ভেঙে গেল। ক্যান্টিনের বয়টা চা নিয়ে এসেছে। ইসতিয়াক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিতে নিতে গুনে দেখলো, দু'কাপ চা এসেছে। প্রথমে দুকাপেরই অর্ডার দেয়া হয়েছিল, ওরা দুজনই শুধু ছিল তখন। ঐ ছেলেটা আসার পর আর নতুন করে অর্ডার দেয়া হয় নি। বাগড়া দিক আর যা-ই দিক – চা কম থাকাটা সইবে না ঐ ছেলেটার। তাই সে তাড়াতাড়ি করে বলল, "মামা, আরেক কাপ লাগবে যে!”
বলতে বলতে নিজের কাপটা সুবর্ণার ক্লাসমেটের সামনে দিয়ে দিল। সুবর্ণা শুধু চায়ের কাপের দিকে এক পলক তাকালো, তারপর আবারও তার কথায় ব্যস্ত হয়ে গেল। বয়টা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল, চা আনতে। ইসতিয়াক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, সুবর্ণার ডিস্টার্ব হয় নি তো?! নাহ, সুবর্ণার মধ্যবয়স্ক যুবতী চোখগুলো দিয়ে সে তাকিয়ে আছে ওর ক্লাসমেটের দিকে, খুব ভাল মনযোগ ওর। কিন্তু দুর্ভাগ্য! ইসতিয়াকের চোখগুলো সুবর্ণার মধ্যে আরেকবার ডুবে যেতে নিলো, ঠিক মুহূর্তেই সুবর্ণা তার দিকে তাকালো। "ইসতিয়াক ভাই, আজ উঠি। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।"
একটু হতচকিত হয়ে সে বলল, “আরে, চা-টা তো শেষ করো… ভাই আপনি তো নিলেনই না।"
ছেলেটা তাড়াহুড়োয় শুধু বলল, “আজ না, আরেকদিন হবে।”
সুবর্ণা বলল, “আচ্ছা ইসতিয়াক ভাই, আসি।”
ইসতিয়াক চাইছিল সুবর্ণা আরেকটু থাকুক, আরেকটু কথা বলুক, আরেকটু তার নয়ন জুড়ানো চোখগুলোতে হারিয়ে যেতে পারুক সে। কিন্তু ভাগ্য সেই সুযোগ দিল না।
আসলে ইসতিয়াক সুবর্ণার জীবনে কিছুই না। সুবর্ণা যে সুন্দর গান গাইতে পারে সেটা শুনলে যে কেউ ওর জন্য পাগল হয়ে যাবে। সুবর্ণা সবকিছুতেই খুব ভাল। লেখাপড়ায়ও বেশ। তার একটা সুন্দর গুণ হচ্ছে সে সবার সাথে কথা বলে, বিপদে-আপদে সবার পাশে থাকার চেষ্টা করে। এভাবেই তো তার সাথে পরিচয় ইসতিয়াকের। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের দিন সে কলম আনতে ভুলে গিয়েছিল। অনেক অন্যমনস্ক তো সে! তার ঠিত পাশেই সিট পড়েছিল সুবর্ণার – ভাগ্য যে কিভাবে মিলিয়ে দিল তাদের! তখন সুবর্ণা একটা কলম ধার দিয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হল কলমটা হাতে নেয়ার সময় ইসতিয়াকের মধ্যে কেমন যেন একটা উপলব্ধি কাজ করল। মনে হচ্ছিল যেন সারাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সত্য যেন সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হল এই উপলব্ধিটা আর কখনো জীবনে কোন মেয়ের কাছ থেকে সে পায় নি। মনে মনে বলে সে, “বিশ্বাস কর, আমি তোর দেহের প্রেমে পড়ি নি রে, অন্যদের মত। আমি তোর মনের প্রেমে পড়েছি। তুই খুব ভালো একটা মেয়ে।”
চায়ের দাম দিয়ে সে উঠে গেল ক্যান্টিন থেকে।
ইসতিয়াকেরও ক্লাস আছে। তবে আধাঘণ্টা পর। কি করবে আর, সে লাইব্রেরির দিকে রওনা হল। ভার্সিটিতে তার আর কোন ক্লোজ বন্ধুও নেই, যে আড্ডা দিবে। তাই সে লাইব্রেরিতেই বেশিরভাগ সময় কাটায়।
লাইব্রেরিতে গিয়েই সে গ্রিক মিথোলজির মানে গ্রিক পুরাণের বইটা নিয়ে বসলো। ইংরেজি সাহিত্যে পড়ে সে। সুবর্ণাও পড়ে একই বিষয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রদের গ্রিক পুরাণের এসব কাহিনী জানা থাকা লাগে, নাহলে তো লোকে হাসবে! যদিও এগুলো কোনদিন সত্য ছিল না, শুধুই গল্প, তবে পড়তে কিন্তু খুব মজার। তখনকার গ্রিক লোকেরা দেব দেবীতে বিশ্বাস করতো। সেই দেব দেবীরা নাকি থাকতো "অলিমপাস” নামে এক পাহাড়ের উপরে। একেক দেবতার ছিল একেকরকম ক্ষমতা। কেউ ছিল যুদ্ধের দেবতা, কেউবা প্রকৃতির। তাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি, বাক-বিতণ্ডা আর প্রেম – এই সব নিয়েই যত কাহিনী। প্রসঙ্গ বোঝাতে বইয়ের পাতায় পাতায় অসংখ্য দেব দেবীর ছবি দেয়া আছে বইটায়। এক পাতায় লেখা, আরেক পাতায় ছবি। ছবিগুলো অবশ্য মোটেও শালীন নয়। সেসব ছবি দেখলে যেকোন মৌলভী টাইপ লোক দশবার তওবা করবে! কিন্তু লেখাপড়ার বিষয় তো, পড়তে তো হবেই।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে একসময় ইসতিয়াক এসে পড়ে ভালোবাসার দেবতা কিউপিডের পাতায়। কিউপিড নাকি মানুষের মধ্যে ভালোবাসা জাগাতে পারতো। দেবতা হলেও সে বাচ্চা শিশুর রূপ ধারণ করতো এবং তার পিঠে তীর নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। যার ভেতরে ভালোবাসা জাগ্রত করতে চাইতো তাকে তার জাদুময় একটা তীর মেরে বসতো। তীরের জাদুতে তখন সেই লোকটার ভিতরে ভালোবাসার আবেগ চলে আসতো!
সুবর্ণা বোধহয় তাকে ঠিক এমনই একটা তীর ছুড়ে মেরেছে! এজন্যই বোধহয় সে এতটা চাইতে শুরু করেছে সুবর্ণাকে। যদিও সুবর্ণা কিছুই জানে না এসবের। এত কাছে থেকেও সে জানে না কোনকিছু – ব্যাপারটা কেমন যেন লাগে ইসতিয়াকের। কাছের এক বন্ধুকে যেমন আরেক বন্ধু কোন খবর জানাতে চায়, ঠিক তেমনি বলে ফেলতে ইচ্ছে করে, “এ্যাই জানিস! আমার না তোকে ভাল লাগে। কেন জানিস? তুই অন্যদের থেকে অন্যরকম তো, তাই।” ভেবে মনে মনে হাসে ইসতিয়াক। কিন্তু না, জানানো যাবে না। সে চায় তার বলাটা স্পেশাল হোক। এটা নিয়েই সে ভাবে শুধু আজকাল। সে অন্যদের মত শুধু কয়েকটা মুখস্থ শব্দ বলতে চায় না। তার ভালোবাসা তো আর অন্যদের মত নয়, অন্যদের মত প্রকাশ করলে চলবে না। মনে মনে বলে সে, "কিভাবে বলি তোকে? কিভাবে বলি ভালোবাসি?”
++++++++++++++++
আবারও সেই স্বপ্ন।
আজকাল বেড়ে গেছে স্বপ্নটা। এখন সে প্রতিদিন দেখে স্বপ্নটা। ঐ আগের স্বপ্নই। কিন্তু কোনদিন সেই চেহারাটা দেখতে পায় না সে।
একদিন এক পলক দেখেছিল চেহারাটা। কিন্তু ইসতিয়াকের মা সেদিন এমনভাবে তাকে ঘুম থেকে ডেকেছিল যে কবরস্থানের লাশও বোধহয় উঠে যাবে। উঠে দেখলো ডাকের তোড়ে সে সব ভুলে গেছে।
ওঠার পর দাত ব্রাশ করতে করতে সে মনে করার চেষ্টা করলো চেহারাটা। কিন্তু নাহ্! কিছুতেই মনে পড়লো না।
+++++++++++++++++
ক্যাম্পাসে তুমুল বৃষ্টি। সকালে রোদ ছিল, কিন্তু বেলা গড়াতে গড়াতে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ক্যাম্পাসের খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছেলে মেয়েগুলো সব দৌড়ে দৌড়ে দালানের আশ্রয়ে চলে আসতে শুরু করলো – বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য।
ইসতিয়াক এতক্ষণ দেখছিল এসব কাণ্ড। তার মত আরো অনেকে ভীড় জমিয়েছে করিডোরে, বৃষ্টি দেখবে বলে। ভিড়ের জোড়ে রেলিংয়ের কাছে যাওয়া যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে মোটামুটি ঠেলে ঠুলে সে রেলিংয়ের কাছে চলে আসলো। সারাজীবনে অনেক বৃষ্টি দেখেছে সে। কিন্তু এই বৃষ্টিটার মায়া কেন যেন অন্যরকম লাগলো তার কাছে। বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে সে দেখছিল বৃষ্টির দৃশ্য। কেন যেন আজ বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে কাছে গিয়ে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে তার। কি অপরূপ সুন্দর সে দৃশ্য! হাত বাইরে দিয়ে কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটাকে অনুভব করতে চাইলো। কিন্তু মনে হয় পারলো না।
এমন সময় তার খেয়াল হল, সুবর্ণা কোথায়? সে কি এসেছে আজ? মনে মনে ভাবে সে, “যখন তোকে খুব দরকার, তখনই পাই না কাছে।"
নাহ! যে করেই হোক-- আজ খুঁজতেই হবে সুবর্ণাকে। করিডোরে থাকা মেয়ে ছেলেগুলোকে প্রায় ঠেলেঠুলে সে খুঁজতে লাগলো সুবর্ণাকে। তার যেন কোন রুমে ক্লাস আজ? খুঁজতে খুঁজতে মনে হল পুরো ভার্সিটিটা অন্যদিনের চেয়ে আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। এত বড় ভার্সিটিতে কিভাবে খুঁজে করবে সে আজ সুবর্ণাকে?
প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ইসতিয়াক এসে পড়লো সুবর্ণার ক্লাসরুমের কাছে। ক্লাসরুমের দরজায় দেখা হয়ে গেল সুবর্ণার এক ক্লাসমেটের সাথে। ক্লাসমেটকে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, “সুবর্ণা কোথায়? জানো কিছু?”
“কি জানি ভাই, বলতে পারলাম না।”
ক্লাসরুমের ভেতরে ঢুকে দেখে প্রায় জনশূণ্য রুম। সবাই বাইরে বৃষ্টিমুখর পরিবেশ উপভোগ করছে। গুটিকয়েক লোকজন ক্লাসের ভিতর ছিল। তারা এদিক সেদিক অলস সময় কাটাচ্ছিল। কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছিল, আর কেউ মোবাইল ফোনে ব্যস্ত। কিন্তু কোথাও সুবর্ণাকে দেখা যাচ্ছে না। একজনকে কাছে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, “ভায়া, সুবর্ণাকে দেখেছেন? আজ এসেছে ও?”
সে বলল, “হ্যাঁ, একটু আগে তো এখানেই ছিল। এখন...”
ইসতিয়াক শুধু বললো, “ধন্যবাদ...” বলেই ছুটে পালিয়ে গেল ক্লাসরুম থেকে। সে জানে কোথায় গেছে সে।
যে দালানটাতে এতক্ষণ ছিল সে, তার ঠিক পিছনেই একটা বড় ফুটবল মাঠ। সেখানটাতে অনেক সময় কাটিয়েছে ইসতিয়াক আর সুবর্ণা। তার মন বলছে ওখানেই তাকে পাবে সে। মোটামুটি আরেকটা দৌড় লাগালো সে।
হুম, ঠিক তাই। আসলেই একদম পারফেক্ট। এরকমটাই চাইছিল সে। পরিবেশটা একেবারে কল্পলোকের মত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বিশাল এক সবুজ মাঠ, ঘাসে ঢাকা। লোকজন বলতে গেলে নেই। একজোড়া স্যান্ডেল হাতে নিয়ে কে যেন একজন দাড়িয়ে আছে। পড়নে তার একটা নীল – নাহ, আকাশী রঙয়ের জামা, আর দুহাতে নীল রঙয়ের চুড়ি। বিশাল সেই সবুজ মাঠের বুকে ছোট্ট সেই মানুষটাকে একটা নীল-আকাশী পরীর মত লাগছিল।
ইসতিয়াক ধীরে ধীরে কাছে যায় তার, একদম ধীর পায়ে – যাতে সে টের না পায়। হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছিল সামান্য ঘাসও যেন অনেক উচু গর্জন করছে আজ -- তার নীরব উপস্থিতি যেন প্রকাশ করে দিতে চাইছে ঐ পরীটার কাছে। তারপরও ঘাসের উপর পা বুলিয়ে ধীরপায়ে সে এগিয়ে গেল, ঐ পরীটার দিকে। একসময় সে এসে পড়লো প্রায় তার পাশাপাশি। আড়চোখে সে তাকিয়ে দেখতে পেল পরীটা চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে – বাম হাতে স্যান্ডেল জোড়া ধরা আর ডান হাত দিয়ে বাম হাতটাকে ধরে রেখেছে। মাথাটা আলতোভাবে অন্যপাশে হেলে রেখেছে। তার ঘাড়ের চামড়ার উপর অলসভাবে কিছু ভেজা চুল এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। চুলগুলো সরে যাওয়ায় দেখতে পেল, তার কানে একটা নীল ঝালর যেন তারই অপেক্ষায় দোল খাইছে মাঝে মাঝে।
ইসতিয়াক মনে মনে বললো, “আমি পারবো না। আমি পারবো না রে। আমায় মাফ করে দিস।”
বৃষ্টির মাঝেও মেঘের দল ভর করলো তার মনে। বেদনার বৃষ্টিস্নাত হতাশা নিয়ে সে ফিরে যেতে চাইলো। সে পা বাড়ালো উল্টো দিকে। শুধু শুধুই জামা কাপড় ভিজিয়েছে সে… বন্ধুরা দেখলে তো হাসবে। ব্যাগে থাকা রুমালটা দিয়ে মাথাটা মুছে ফেলতে হবে, নাহলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে--এগুলোই ভাবছিল সে। হঠাৎ করে একটা হাত এসে তার হাতটা ধরে ফেললো। হাতটা অদ্ভুত নরম একটা হাত, কিন্তু ধরাটা খুব শক্ত, যেন সে পড়ে যেতে নিচ্ছে সে অবস্থায় তাকে খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে সেই হাতটা, বাঁচানোর জন্য। তাহলে কি ইসতিয়াকের আনমনে তাকিয়ে থাকা সবই বুঝতে পেরেছিল সে?
আদনান শামীম, ১৯/০২/২০১৬
এডিট: ১২/০৭/২০১৬